পিকিং মানুষের পরিচয়
আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে পিকিং মানব সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। পিকিং মানব চীনে পাওয়া যায়। এটা চীনা সভ্যতার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য সংযোগ করল। এ গোষ্ঠী আদি মানুষের এক ধরনের উদাহরণ, যা হোমোইরেকটাস তথা খাড়া মানুষের অন্তর্ভুক্ত। পিকিং অর্থ চীনা মানব। এদের বৈজ্ঞানিক নাম পিথিকানথ্রোপাস।
আবিষ্কার : ১৯২০ সালে সুইডেনবাসী ড. আন্ডারসন চীনের রাজধানী পিকিং থেকে ৬৪-৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণ- পশ্চিমে চুকুতিয়েন গ্রামে চুনাপাথরের পাহাড়ের গায়ে কাটা প্রকাণ্ড এক গুহার মাটি অদ্ভুত রকম লাল দেখে কোনকিছু পাওয়ার সন্দেহ প্রকাশ করেন।
১৯২১ সালে ঐ গুহার মাটি খুঁড়ে মানুষের দাঁতের মত দাঁত পাওয়া গেল। এছাড়া আরও ৩০টির অধিক এ ধরনের আরও দলিল পাওয়া যায়, লক্ষাধিক হাড়গোড় ও হাতিয়ার পাওয়া যায়। ১৯২৭ সালে চুকুতিয়েন গুহার মাটি খুঁড়ে নিচে চোয়ালের আরও একটি জীবাশ্ম মাটির দাঁত পাওয়া যায়। কানাডার অধ্যাপক Dr. Davidson Black এবং তার সহকারী Dr. Pei Wenchung ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ গবেষণা করে দাঁতগুলো যে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের তা নিশ্চিত হন এবং তার বৈজ্ঞানিক নাম দেন পিথিকানথ্রোপান, পিকিনেনচি বা পিকিং এর চীনা মানুষ ।
আকার : এরা জাভা মানবের চেয়ে উন্নততর ছিল। তবে শরীরের গড়নের দিক দিয়ে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। কেবল মস্তি স্ক কিছুটা বড় ছিল। তাদের হাত বেশ মোটা, শক্ত চোয়াল, লম্বা দাঁত ও আধুনিক মানুষের চেয়ে মস্তিষ্ক ছোট। ফসিল থেকে বুঝা যায়, এসব মানুষ সাধারণ ৫ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা।
হাতিয়ার : নদীগর্ভ থেকে এবং বেশ দূরবর্তী জায়গা থেকে পিকিং মানুষেরা তাদের পাথরের হাতিয়ার তৈরির উপযোগী সামগ্রী সংগ্রহ করত। যেসব পাথর দিয়ে হাতিয়ার তৈরি করা হতো, তাদের মধ্যে কোয়ার্টজ, কোয়ার্টজাইট প্রভৃতি স্ফটিক পাথরও ছিল। সামগ্রীর পর্যাপ্ততা দেখে মনে হয় তারা গুহার মধ্যে বসে হাতিয়ার তৈরি করত। একটি পাথর অন্য একটি পাথরকে আঘাত করে ভেঙে হাতিয়ার তৈরির কাজ করা হতো।
হাড়ের তৈরি হাতিয়ার : মোস্তরীয় সাংস্কৃতিক সময়ে হাড়ের তৈরি হাতিয়ার হতো যা পিকিং মানুষেরাও তৈরি করত। আবার হাড় দিয়ে তারা অস্ত্র তৈরি করত, যা তারা নিজেদের মধ্যে কলহের সময় ব্যবহার করত।
পিকিং মানৰ অপেক্ষা জাভা মানবের হাতিয়ার : পিকিং মানব জাভা মানব অপেক্ষা অধিকসংখ্যক হাতিয়ার প্রস্তুত করত। এগুলোর বেশিরভাগ স্থূল ও অমার্জিত চুকুতিয়েন গুহার আশেপাশে প্রস্তর দ্বারা নির্মিত হাতিয়ার পাওয়া যায়। এগুলো দিয়ে মসৃণ করা | বা কাটা, ছিদ্র করা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হতো।
বসবাস : পিকিং মানব যেসব গুহায় বসবাস করত, সেসব জায়গায় বহু ভাঙা ও পোড়া হাড় ও ছাই পাওয়া গেছে। এটা তাদের গুহায় বসবাস করার প্রমাণ দিলেও তারা নিয়মিত বসবাস করত কি না সে ব্যাপারে তেমন কিছু জানা যায় নি। তবে একথা বলা যায়, তারা এসব গুহা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করেছে। তাদের গুহায় প্রাপ্ত হাতিয়ার ও অস্থি তাদের উন্নত সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে।
শিকার : চুকুতিয়েন গুহায় অস্থি সম্ভারে হাতি, গন্ডার, মহিষ ও বাইসনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এ থেকে ধারণা করা হয় তারা পশু শিকারে বেশ পারদর্শী ছিল এবং অন্যান্য পশু যেমন- হরিণ, ভেড়া, ঘোড়া ইত্যাদি শিকার করত।
আগুনের ব্যবহার : পিকিং মানবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আগুনের ব্যবহার। আগুন প্রজ্বলিত করতে তারা জানত না। তবে ব্যবহার করে জীবনযাত্রার স্বাতন্ত্র্য আনয়ন করে তাদের বসতি এলাকায় ছাই, অঙ্গার, পোড়া হাড়, প্রাচীন উঠানের অবশিষ্টাংশ প্রভৃতি তাদের বসতি এলাকায় লক্ষ্য করা যায়। তারা জীবজন্তু শিকার করে পুড়িয়ে বা ঝলসিয়ে খেত ।
স্বগোত্রীভোজী : এরা স্বগোত্রীভোজী ছিল বলে মনে হয়। চুকুতিয়েন গুহায় প্রাপ্ত মাথার খুলি ও অস্থি পরীক্ষা করে বুঝা যায়, স্বগোত্রীয় মানুষের মাথার মগজ ও অস্থিমজ্জা পিকিং মানবের আহার্য ছিল। অনেকে মনে করেন যে, এ ধরনের স্বগোত্র ভোজন নিয়মিত আহার ছিল না, বরং তা শাস্ত্রীয় আচারগত প্রথারূপে প্রচলিত ছিল ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পিকিং মানব অনেকাংশেই আধুনিক মানুষের মত ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় | এসব মানুষের চিহ্ন আবিষ্কারের ফলে মানুষের ভিতর এতদিনকার অজানা সূত্রটি যা কি না এতদিন মিসিং লিঙ্ক বা ছিন্ন মূত্র নামে পরিচিত ছিল সে সম্পর্কে জানা গেল। ফলে জাভা মানব ও . পিকিং মানবের সাথে অস্ট্রালোপিথিকাসসহ অন্যান্য মানব একসূত্রে গ্রথিত করলে মিসিং মিংটি আর মিসিং থাকে না।